যা করেছি, মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে তামিম

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টে প্রথম জয়। অথচ সেটি কিনা আর মনেই রাখতে চান না তামিম ইকবাল! চট্টগ্রামে দ্বিতীয় টেস্ট যে কড়া নাড়তে শুরু করেছে। অতীত ভুলে দলের সবাইকে সেদিকেই তাকাতে বললেন জহিরুল ইসলাম কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে
জহিরুল ইসলাম : অস্ট্রেলিয়া-জয়ের তাৎক্ষণিক অনুভূতি তো কালই শুনেছি। ২৪ ঘণ্টা পর নতুন কিছু কি বলবেন?
তামিম ইকবাল: ভালো লাগছে। তবে এমন নয় যে, এখনো শুধু এই জয় নিয়েই ভাবছি বা সকালে উঠেই তা মনে পড়েছে। হয়তো মোবাইল ঘাঁটছি, ম্যাচের হাইলাইট চলে এল, একটু দেখলাম, এই আর কী! পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি, খেলা-টেলা মাথায় থাকছে না। একদিক থেকে ভালোই হচ্ছে।
জহিরুল ইসলাম : মিরপুরের এই উইকেট তো ব্যাটসম্যানশিপের চূড়ান্ত পরীক্ষা নিয়েছে। টেকনিক্যাল অ্যাডজাস্টমেন্ট কী করতে হয়েছে?
তামিম: আমি আগেও বলেছি, এই উইকেটটা এমন ছিল যে, পরের বলটা কী হবে, আপনি তা জানেন না। গুড লেংথ থেকে বল লাফিয়ে উঠতে পারে, আবার গড়িয়ে গিয়ে উইকেটে লাগতে পারে। আমি তাই এটি যে স্পিনিং উইকেট, তা ভুলে গিয়ে ফ্ল্যাট উইকেট ভেবে খেলেছি। যার মানে বল মিডল স্টাম্পে পড়লে সোজা খেলব। স্পিনের জন্য খেলতে গিয়ে যদি বল সোজা হয়ে যায়, তাহলে তো গেল! আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, এই ম্যাচে স্পিন করা বলে কিন্তু কম আউট হয়েছে। সোজা বা ভেতরে আসা বলে বেশি।
জহিরুল ইসলাম : এমন উইকেটে ব্যাটিং করা তো স্কিলের সঙ্গে মানসিক শক্তিরও পরীক্ষা নেয়, তাই না?
তামিম: তা তো নেয়ই। মনে অনেক কিছু কাজ করে। দ্বিতীয় ইনিংসে ইমরুল যে বলটায় আউট হলো, সেটি তো আমার প্রথম ওভারেও তো হতে পারত। এসব তাই মাথায় রাখিনি। ঠিক করেছি, নরমাল ক্রিকেট খেলব, খুব বেশি শট খেলব না। আবার পজিটিভও থাকব। পজিটিভ মাইন্ডসেট থাকাটা খুব জরুরি। ওয়ার্নারের ব্যাটিং তো দেখেছেন। প্রথম ইনিংসে একটা বলেও ও স্বচ্ছন্দ ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ও পজিটিভ মাইন্ডসেট নিয়ে নেমেছে বলে সেঞ্চুরি করতে পেরেছে।
জহিরুল ইসলাম : মনঃসংযোগটাও বেশি লাগে এখানে, এত লম্বা সময় ব্যাটিং করার সময় মানসিক ক্লান্তির সঙ্গেও তো একটা লড়াই জিততে হয়...
তামিম: তা তো বটেই। ফ্ল্যাট উইকেটে ভালো বলেও চার মেরে দেওয়া যায়, এক রান তো নেওয়া যায়ই। আর এখানে ২-৩-৪ ওভারেও হয়তো একটা রানও হলো না। প্রথম ইনিংসেই যেমন ১৭ থেকে ১৮-তে যেতে আমার ৩৩ বল লেগেছে। আমি ধৈর্য হারাইনি। জানতাম, একসময় রান করার মতো বল আসবেই।
জহিরুল ইসলাম : এই যে ৩৩ বলে রান নিতে না পেরেও অবিচল থাকলেন তামিম ইকবাল, এটা তো আপনার সহজাত ব্যাটিংয়ের সঙ্গে যায় না। এই পরিবর্তনটা কীভাবে—বয়স-অভিজ্ঞতা-আত্মবিশ্বাস-সমালোচকদের ভয় কোনটির বেশি অবদান?
তামিম: সবকিছুই আছে। তবে এ ধরনের উইকেটে চাপমুক্তির জন্য কখনো কখনো বাড়তি ঝুঁকি নিতেই হবে। প্রথম ইনিংসে লায়নের বিপক্ষে যেমন নিয়েছি, তাতে কাজও হয়েছে। এমন ঝুঁকি নিতে গিয়ে আউট হয়ে গেলেও বুঝতে হবে, এটা আমার প্ল্যানেরই অংশ।
জহিরুল ইসলাম : আপনার বিচারে এই দুটি ইনিংস কোথায় থাকবে?
তামিম: ওপরের দিকেই। আপনাকে এর আগেও বলেছি, অনেক সময় ৩০-৪০ রানও সেঞ্চুরির চেয়ে বড় হতে পারে। এখানেও সেই তৃপ্তিটা আছে। তবে এক শ মিস করার দুঃখটা তো থাকবেই। ম্যাচে যদি দুইটা সেঞ্চুরি হয়ে যেত...ভাবা যায়!
জহিরুল ইসলাম : বয়স-অভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে ব্যাটসম্যান তামিমের এখন মধ্যগগনে থাকার কথা। গত কিছুদিন রানেও সেটির প্রমাণ মিলছে। সম্ভবত আপনার সেরা সময় যাচ্ছে এখন। কোনো রহস্য আছে?
তামিম: গত দুই বছর সিরিজের আগে, ম্যাচের আগে আমার প্রস্তুতিটা খুব কাজে দিচ্ছে। ব্যাটিং প্র্যাকটিসটা বেশিও করছি না, কমও করছি না। মাথা খুব পরিষ্কার থাকছে। সবকিছু মিলিয়ে বলতে পারি, মানসিকভাবে আমি এখন আদর্শ একটা অবস্থায় আছি।
জহিরুল ইসলাম : প্রস্তুতির ব্যাপারটা যদি একটু বিস্তারিত বলতেন...
তামিম: এই প্রস্তুতির মধ্যে ঘুমটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আগে হয়তো ম্যাচের আগে ঘুমাতে ঘুমাতে রাত সাড়ে বারোটা-একটা বাজিয়ে ফেলতাম। লেট নাইট-টাইটের জন্য নয়, আমি কেমন ছেলে, তা তো আপনি জানেনই। হয়তো রুমেই এটা-ওটা করতে করতে ঘুমাতে দেরি হয়ে যেত। গত দুই বছরে বুঝেছি, ঘুম কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আর প্র্যাকটিসে কত বল খেললাম, সেটি আর আমার কাছে কোনো ব্যাপার নয়। ২-৩ ঘণ্টা প্র্যাকটিসও করি না। হয়তো পনেরো মিনিট ব্যাটিং করি, তবে সেটি খুব কঠিনভাবে। আপনি ভালো সময়ের কথা বলছেন, তবে আমি কিন্তু পুরোপুরি খুশি না। অনেক রান করেছি, কিন্তু আরও ভালো করতে পারতাম। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে (দ্বিতীয় টেস্টে) ৮২ রানে আউট হয়ে গেলাম, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৯৫ রানে (চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে)—এগুলো তো সুযোগ নষ্ট করা।
জহিরুল ইসলাম : অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট, একটু কি অন্য রকম অভিজ্ঞতা?
তামিম: অন্য রকম বলতে ওদের খেলা অনেক দেখেছি, অনেকের খেলা আমার পছন্দও। ওদের সঙ্গে একই মাঠে টেস্ট খেলছি, এটাতে তো একটু বাড়তি রোমাঞ্চ ছিলই। দেখেছি, ওরা কীভাবে কী করে।
জহিরুল ইসলাম : অস্ট্রেলিয়ানদের তো ব্যাট-বলের সঙ্গে মুখও সমানতালে চলে। স্লেজিংয়েও কি বৈচিত্র্যের দেখা পেলেন?
তামিম: (হাসি) বলতে পারেন। ওদের ধরনটা আলাদা। যখন কথা বলে, একজন বলে না। দল বেঁধে কথা বলে। চার-পাঁচজনের দল। সিংহ যেমন দল বেঁধে ঘোরে, ওরাও চার-পাঁচজন একসঙ্গে আক্রমণ করে। আর ওদের খেলার ধরনে একটা পজিটিভ ব্যাপার তো সব সময়ই থাকে।
জহিরুল ইসলাম : অস্ট্রেলিয়ার এই দলে স্লেজিংয়ের নেতৃত্ব কে দেয়?
তামিম: সেটাই তো বুঝলাম না। একদিন তিন-চারজন, পরদিন আবার অন্য তিন-চারজন।
জহিরুল ইসলাম : এত লম্বা সময় ব্যাটিং করেছেন, কী কী বাণী শুনতে হলো, তার দু-একটা বলুন তো শুনি...
তামিম: ওসব না-ই বলি। ছাপতে পারবেন না (হাসি)।
জহিরুল ইসলাম : আপনারা জবাব দেননি?
তামিম: দিইনি মানে? ভালোই দিয়েছি। আমরাও ওটা ভালোই পারি।
জহিরুল ইসলাম : গত দশ মাসে তিনটি বড় জয়। ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে এক নম্বর বলবেন কোনটিকে?
তামিম: তিনটার মূল্য তিন রকম। শ্রীলঙ্কারটা ওদের মাঠে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়টা আবার আমাদের মনে জয়ের বিশ্বাস এনে দিয়েছে। সাকিবও মনে হয় এই কথাটা বলেছে। আমি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়টাকেই এগিয়ে রাখব, সেটা আমি এক শ করেছিলাম বলে না। আমরা নিজেরাও অভ্যস্ত না, এমন উইকেটে খেলাটা ছিল বড় এক চ্যালেঞ্জ। এখানে আমি অধিনায়ককে কৃতিত্ব দেব। উইকেটের ব্যাপারে তাঁর মতামতটা তো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিন-চার দিনে খেলা শেষ হয়ে গেলে যাক, এমন উইকেটে খেলার ঝুঁকি নেওয়ার সাহসটা ও দেখিয়েছে।
জহিরুল ইসলাম : ইংল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ০-১ টেস্টে পিছিয়ে থেকে বাংলাদেশ সিরিজের শেষ টেস্ট খেলতে নেমেছিল। এখানে ১-০ টেস্টে এগিয়ে থাকায় তো সিরিজ জয়ের বড় সুযোগ...
তামিম: অবশ্যই জিততে পারি। আমি বলব, আমরা যা করেছি, তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। চট্টগ্রামে গিয়ে দুই দিন প্রস্তুতি নিয়ে খোলা মনে মাঠে নামতে হবে। অস্ট্রেলিয়ানদের তো চিনি, ওরা সর্বস্ব দিয়ে ঝাঁপাবে। তবে আমাদের একটা সুবিধা আছে, অস্ট্রেলিয়ার এই দলের কেউ চট্টগ্রামে কখনোই খেলেনি।
জহিরুল ইসলাম : বাংলাদেশ নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জনের সামনে দাঁড়িয়ে, চট্টগ্রামে মাঠে নামার সময় এটা তো মাথায় কাজ করবেই, তাই না?
তামিম: এটা চিন্তাই করতে চাই না। চিন্তা করা মানেই বাড়তি চাপ নেওয়া। এখন সবাই জানে, আমরা কী পারি। আর আমাদের জন্য সব টেস্টই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
জহিরুল ইসলাম : সাকিব আল হাসান তো আবারও নিজেকে সুপারম্যান মনে করাল। কী বলবেন তাঁর সম্পর্কে?
তামিম: বাংলাদেশের জন্য সাকিব যা করেছে, তা অবিশ্বাস্য। কিন্তু আমি বলব, ও আরও ভালো করতে পারে। সাকিব যেদিন চায়, সেদিন ও অদম্য। ও যদি নিয়মিত এমন চায়, তাহলে এমন সব পারফরম্যান্স করতে পারবে, যা বিশ্বে কেউ কখনো দেখেনি। আমি অনেক বড় কথা বলছি। কিন্তু আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, ও মন থেকে চাইলে নিজেকে আরও ওপরে নিয়ে যেতে পারে, বাংলাদেশকেও সেখানে নিয়ে যেতে পারে। এমন প্লেয়ার আমি আর দেখিনি। ও অনেক দিয়েছে, দিচ্ছে, তবে আরও বেশি দিতে পারে।
জহিরুল ইসলাম : সাকিবকে কখনো এ কথা বলেননি?
তামিম: সব সময়ই বলি।
জহিরুল ইসলাম : শুনে সাকিব কী বলে?
তামিম: শুধু হাসে।
জহিরুল ইসলাম : সাকিব কোথায় বাকিদের চেয়ে আলাদা?
তামিম: প্রথমত ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভায়। বোলিং তো অসাধারণ। ব্যাটিংটাকে আমি বলব ‘স্ট্রিট স্মার্ট’, দেখতে হয়তো অত সুন্দর না, কিন্তু ও জানে কীভাবে রান করতে হয়। সব মিলিয়ে যে প্যাকেজটা, সেটি রীতিমতো ডেঞ্জারাস। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথাও বলতে হবে। সাকিব মানসিকভাবে অসম্ভব শক্ত।
জহিরুল ইসলাম : আপনার দেখা ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শক্ত?
তামিম: অবশ্যই, আর কেউ ওর ধারেকাছেও আসবে না।
যা করেছি, মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে তামিম
Reviewed by Unknown
on
সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৭
Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই