গর্ভপাত ও গোপনীয় বিষয় ! ডা. অপূর্ব পন্ডিত

আমাদের সমাজে গর্ভপাত গোপনীয় একটি বিষয়। বিপদ, ভয়, সংকোচ, ঘৃণা, লজ্জা এরকম হাজারো নেগেটিভ এপ্রোচের কারণেই একটি মেয়ে তার গর্ভের সন্তানকে অনেক সময় নষ্ট করে ফেলতে চান, কোনও কোনও সময় বাধ্য হন, কখনও দেখা যায় মেয়েটি বাজে কোনও ঘটনার শিকার। জীবনে কিছু সময় আসে যখন গর্ভপাত না করেও উপায় থাকে না। স্বাস্থ্যগত কারণে যেমন, জটিল হূদরোগ,অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপ, অতিরিক্ত ডায়াবেটিস ইত্যাদি অর্থাৎ যখন মায়ের স্বাস্থ্যহানির আশংকা থাকে তখন গর্ভপাত করানো হয়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনী ও প্রসূতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা: জয়শ্রী রায় বলেন, যেসব রোগী হার্টের রোগ বা অন্য জটিল কোন রোগে ভোগেন তাদেরকে জরুরী ভিত্তিতে আমরা এখানে ভর্তি করে এবোরশান করাই। তবে এক্ষেত্রে রোগীকে অবশ্যই রোগের জন্য সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের কাছ থেকে অনুমতি আনতে হয়।
এম.আর কী?
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনী ও প্রসূতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা বলেন, এম আর(মিন্সট্রুয়াল রেগুলেশান) হলো প্রাপ্ত বয়স্ক নারীদের মাসিক নিয়মিত করনের নিমিত্তে একটি বিশেষ অবস্থা । একজন নারী যখন সন্দেহ করেন যে তার গর্ভধারণ বা অন্যকোন বিশেষ সমস্যার কারনে মাসিক বন্ধ আছে তখন তিনি এম আর করিয়ে নেন। শেষ মাসিকের ৬-৮ সপ্তাসের মধ্যে ড্রপড মাসিক কে নিয়মিত করার নামই এম আর। সেখানে গর্ভের সন্তান এল কি এল না এটা কোন বিষয়ই না ।
তিনি আরো বলেন, ওষুধের পাশাপাশি সার্জারির মাধ্যমেও এম আর করা যায়। তবে সবশেষ মাসিকের দিন থেকে ৩৫-৪৫ দিনের মধ্যে যদি রিপোর্ট করা হয় সেক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।
গর্ভপাত মানে কি হত্যা ?
উত্তরে ডাঃ রাশিদা খানম, মিটফোর্ড হাসপাতালের গাইনি এবং অবস বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার প্রতিক্রিয়ায় জানান,এটাকে গর্ভপাত বলা ঠিক না। এরকম ভাবনা না এনে বরং বলব ৬-৮ সপ্তাহ পর্যন- মা যদি প্রেগনেন্সী টার্মিনেট করতে চান তবে তা করতে পারা অবশ্যই তার অধিকার। ১০-১২ সপ্তাহ পর্যন- এটা এবোরশান। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে এরকম এবোরশান করা হয় না। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে সরকারি ভাবে এম আর সেন্টার কাজ করে। সেখানে গর্ভপাতের কাজ করে মূলত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। গাইনি বিশেষজ্ঞ’র মতে গর্ভধারণের ২ মাসের মধ্যে গর্ভপাত ইচ্ছে করলেই করানো যেতে পারে। অবিবাহিত মেয়ের গর্ভধারণ বিষয়টাই পুরোপুরি অসামাজিক, অনৈতিক, গর্হিত অপরাধ। অনৈতিক, নিষিদ্ধ যৌনমিলনের ফসল হিসেবে সন্তান যদি এসেই যায় কারও গর্ভে কিংবা বিয়ের পর স্বাভাবিক, নৈতিক মিলনের ফসল হিসেবে কারও গর্ভে যদি সন্তান আসে তবে তাকে মেরে ফেলা আসলে কতটা যৌক্তিক এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি তিনি।
আমাদের দেশে মহিলারা পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজে নিজের স্বাস্থ্যসেবার কথা বলতেই পারেনা। সন্তান নেব না সে কথা বলার সুযোগ কি তার আছে? সরকার গর্ভপাতকে কখনোই আইনসিদ্ধ বলছে না। তবে মাসিক নিয়মিতকরনের পুরো প্রক্রিয়াটিই সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। সারা দেশে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা মাসিক নিয়মিতকরন বা এম আর করানো হয়। বার বার এম আর করানো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর । তবে আমাদের মেয়েরা সহজেই এমআর করে ফেলতে পারে এটাও একটা খারাপ দিক উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস ও গাইনী বিভাগের অধ্যাপক ডা. শায়েলা শামীম বলেন যারা সন্তান নিতে চাননা বা অসচেতনভাবে গর্ভে সনত্মান চলে আসলে মহিলারা এম আর করে থাকেন। এ সেবার সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারনে দেখি যে কোন কোন মহিলা ৩০ বছর বয়সের মধ্যে ৭-৮ বারের মত এম আর করান যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই খারাপ। এটা নারীর স্বাস্থ্যকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। আর এম আর কে আমরা স্বাভাবিকভাবে বিবেচনা করলেও নিশ্চিতভাবে এটা একটা হত্যাকান্ড। কারন যখন এম আর করানো হয় তখন ইতোমধ্যে গর্ভে একটা প্রাণের সঞ্চার হয়ে যায়।
অনিরাপদ যৌনমিলন,অনিরাপদ গর্ভাবস্থা,অনিরাপদ গর্ভপাতের বিরুদ্ধেই সরকারের কাজ। গর্ভপাত প্রিভেন্ট করার জন্য মাসিক নিয়মিতকরণ চালু আছে এবং এলাউড পরিবার কল্যান পরিদর্শিকা এমআরের কাজটি করেন। এদেরকে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এমআর ট্রেনিং দেয়া হয়। বিভাগীয় হাসপাতাল,উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এমনকি ইউনিয়ন লেভেলে রয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। এছাড়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যান কেন্দ্র রয়েছে দেশে এবং সাবএসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার কেন্দ্রটির নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। এদেরকে এম আর ট্রেনিং দেয়া হয়। এ ছাড়া মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে যারা জরুরী প্রসুতি সেবা সহ এম আর ডিএন্ডসির কাজ গুলো করে। ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিল পর্যন- পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সাপ্লাই দেয়।
সন-ান অনেক ভালোবাসার, অনেক আদরের, অনেক আশার ফসল। জীবনের উত্তরাধিকার, সম্পদের উত্তরাধিকার, শুধু না সন্তান হলো মানুষের স্বাভাবিক যৌনজীবনের অনন্য সার্থকতা। সন-ান ধারণ একজন মায়ের জন্য গর্বের, আনন্দের। একজন মা তো শুধুই মা। মা নাকি তার প্রসব বেদনার মতো আনন্দ আর কোনও কাজেই পান না। সেই মা একটি মেয়ে, একজন মহিলা যখন তার গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করে ফেলতে চান কিংবা বলা যায় মেরে ফেলতে চান সেটা নিশ্চয়ই শুধু সামাজিক আইন দিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনী ও প্রসূতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গর্ভপাতকে সব সময়ই খারাপ চোখে দেখা হয়। এমনকি বিবাহিত দম্পতিও এই সমস্যা থেকে মু্ক্ত নয়। অবিবাহিত ও অনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে হওয়া গর্ভাবস্থার কথা বাদই দিলাম। আবার সরকারিভাবে গর্ভপাত এখনো বৈধতাই পায়নি। মূলত গর্ভপাতকে এড়ানোর জন্য-ই এম আরকে বৈধ করা হয়েছে। তাই অনেকেই দক্ষ-অদক্ষ ডাক্তারের শরণাপন্ন হন এ কারনে অনাকাংক্ষিত হারে দেশে গর্ভপাতে মৃত্যুহার বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, অপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, অনভিজ্ঞ সেবাপ্রদানকারীদের দ্বারা এবং অনিরাপদ পরিবেশে এম আর করালে এমআর পরবর্তী জটিলতা দেখা দেয়। সুতরাং সেপটিক গর্ভপাত প্রতিরোধের জন্য অনুমোদিত আদর্শ কেন্দ্র হতে এমআর সেবা গ্রহণ করা উচিত।
সরকারি এই কার্যক্রমের পাশাপাশি অনেকগুলো এনজিও প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্যভুমিকা রাখছে মেরিস্টোপস,সূর্যের হাসি চিহ্িত পারিবারিক স্বাস্থ্য ক্লিনিক। কিছু আধুনিক হাসপাতাল যেমন ল্যাব এইড, আয়শা মেমোরিয়াল, স্কয়ার হাসপাতাল প্রসুতীসেবায় এবং গর্ভকালীন সেবায় কাজ করছে।
অনেক অনেক প্রতিষ্ঠান এক দুইটা রুম নিয়ে বিনা ব্যাথায় বিনা ডাক্তারে অনভিজ্ঞ দাই দিয়ে এম আর ডিএন্ডসির গোপনীয় চিকিৎসার নামে বেআইনী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।এগুলো অসামাজিক কার্যক্রমের এক উৎসস্থল।
কি হয় না সেসব সেন্টারে?
অনেক স্থানে বেবীদের নুন্যতম চিকিৎসা সুবিধা নেই। অপারেশন থিয়েটার এর যন্ত্রপাতি নেই, ডাক্তার, সিস্টার কিছুই নেই। হাসপাতাল হিসেবে সরকারি কোন নিবন্ধন নেই এদের অনেকেরই। প্রতিষ্ঠান বললে ভুল হবে। এক শ্রেনীর ধান্দাবাজী সেন্টারগুলো সরকারি কর্তাদের ঘুষ দিয়ে বিভিন্ন ভাবে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি দিয়ে এ ধরনের সেন্টারগুলোকে চালিয়ে যাচ্ছেন সরকারের নাকের ডগায়।
অনিরাপদ মাতৃত্ব রোধে আমাদের সবার সোচ্চার হওয়া উচিত। ঝুঁকিপূর্ণ এম আর না করে পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে অনাকাংক্ষিত গর্ভের সংখ্যা কমিয়ে এনে নারীর জীবন নিরাপদ করতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই