ঢাকার লাইফ: ২য় পর্ব
Samrat Khan: আজকের লেখা অনেক বড় হয়ে গেল বলে দুঃখিত।
এরপরেরটা ছোট করে লিখব।
ইনশাআল্লাহ।


বন্ধুদের অনেকেই ধুমায় পড়াশোনা করে আর আমি মেরিডিয়ান চিপসের ডাটা এন্ট্রির কাজ করি। এক্সেলের কাজ করি ম্যাক্রো বানায় বানায়। অনেকরে বানিয়ে দেই। টুকটাক কাজে। নীলক্ষেতের অনেকের সাথেই পরিচয় হইলো। একদিন চাপা মারতে গিয়ে ফেঁসে গেলাম, এক ভাই আমারে এক্সেস দিয়া একটা সফটওয়্যার বানায় দিতে কইলো। শুরু করলাম। শেষও করলাম। বিল দিল ৩৫০০ টাকা। ওটাই আমার প্রফেশনালি প্রথম বানানো কোন সফটওয়্যার। বিল বেশি না। কিন্তু আমার সফটওয়্যার দিয়া ডাটার কাজ হয়। এই তখন মেলা কিছু। নিজেরে বিল গেটস ভাবা শুরু করলাম। আসলে তখন ভালো করে আমি বিল গেটস সম্পর্কে জানতাম না। উনি কে? আজও অনেক জানি বলা ভুল।
যাক, কথা আগাই। থাকতাম আব্দুল আজিজ লেন। বিডিয়ার গেটের কাছাকাছি এলাকা। অনেক দিনই এমন হয়েছে দুপুরে রান্না হয় নাই সাবলেট বাসায়, হাতে টাকাও নাই। সাধারণত নূরু ভাইয়ের দোকানে বাকি খাইতে পারতাম। কিন্তু দুপুর বেলায় ওনার দোকান কোনদিনই খোলা থাকতো না। তাই নিরুপায় হয়ে সাগর কাকার বিকেল বেলার মুড়ির ঝুরির অপেক্ষা। সাগর কাকা আইতো, আর আসার সাথে সাথে মুড়ির উপর ঝাপায় পরতাম। এক নাগাড়ে, তিনটা ৫ টাকা না খাইলে পেট ভরত না। সাগর আমার কাছাকাছি বয়সের ছেলে। তবুও ওরে কাকাই বলতাম। ছেলেটা ভালো ছিল। আমার টাকার অপেক্ষায় থাকতো না। ঐ জন্য ভালো বলতেছি না। ছেলেটাকে দেখে অনুপ্রাণিত হইতাম। ঘন্টার অধিক সময় ওর সাথে গল্প করতাম। বাবার প্রতি তার ভালোবাসার পরিমাপ করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু আমি যে স্কেলে মাপতাম ঐ স্কেলটা ওর ভালোবাসার কাছে নেহায়েত ছোট ছিল। ছেলেটার ভাইগুলান নেশা করতো, একটা বোন। ওরে ছাড়া সবাই ছিল অমানুষ। দাদার(সাগরের বাপ) মতে। ওর বাপের কিছু হইলে সাগর পাগলের মত হইয়া যাইত। ওরে দেখে, ওর কথা শুনে বাপের কষ্টের টাকার মর্ম বুঝতে শিখেছি। ছেলেটা দিনে তিন ধরণের কাজ করতো। নিজেকে অনুপ্রাণিত করার এর চাইতে বড় রসদ আর দরকার ছিলনা। নিজেকে দিনে দিনে পরিবর্তন করা শুরু করি। বাবার কাছ থেকে টাকা চাই কম কম। টাকা চেয়ে প্যারা দিতাম কম।
মাঝে মাঝে প্যারা দিতাম। তবে বেশির ভাগ সময়, কষ্ট নিজে সইতাম কিন্তু বাবারে বলতাম না। একবার কলেজ বন্ধ দিল। লম্বা একটা বন্ধ। ১৮ দিনের ছুটি। সবাই বাবা মার আদর নিতে নিজ নিজ বাড়ি গেল। আমি দূর্ভাগা টাকার অভাবে চট্টগ্রাম যেতে পারলাম না। টানা ১৭ টা দিন। টাকা ছিল না বলে পাঁচ তলা থেকে নিচেই নামতাম না। কিভাবে ১৭ দিন গিয়েছে সেটা বলতে গেলে লেখা প্রচুর লম্বা হবে। শুধু এতটুকু বলি ১৭ দিনে আমার খরচ ৩৫০ টাকার উপরে না। এই ৩৫০ টাকার ভিতর চাল ডাল ডিমসহ হাত খরচও আছে। ১৫ – ১৬ দিন পর বাবা টাকা পাঠালো। যেতে হবে ২৪ - ২৫ দিলকুশা, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস। ১৮ দিনের মাথায় সকালে ধানমন্ডি ১৫ থেকে হাটা শুরু করলাম মতিঝিলের উদ্দেশ্যে। তার আগের দিন আমি সকালে খেয়েছিলাম। ৯ টায় রওনা হয়ে ১১:৩০ এ গিয়ে পৌছালাম মতিঝিল। কুরিয়ার সার্ভিস থেকে টাকা উঠাতে হলে আমাকে ২০ টাকা দিতে হবে। কিন্তু আমার কাছে ২০ টাকা নাই। উনাদের বললাম আমার টাকা থেকে নিন। উনাদের নিয়ম নাই বলে, দিলেন না। একদম নাছোড় বান্ধা। দিলেনই না। ভাগ্য আমার সাথে গুরুগম্ভীরতা করে মজা পেত। অগত্যা বসে থাকলাম। যোহরের আযান পরলো। কুরিয়ার সার্ভিসের কাউন্টারের লোক নামাযে গেলেন একবারে দুপুরের খাবার খেয়ে আসবেন। বসে থাকলাম। পরে নিরুপায় হয়ে দুইজনের কাছে চাইলাম। দিলনা। এক মহিলাকে বললাম ফিরেই তাকালো না। এদিকে অফিস বন্ধের টাইম হয়ে গিয়েছে। বাইরে গেলাম একটা দোকানে। অনেকক্ষণ ধরে দাড়ায় থাকলাম পরে হঠাৎ ওনার বেন্সে বসলাম একটু ফাঁকা পেয়ে ওনাকে বললাম। উনি বিশ্বাস করলেন। আমাকে প্রথমে রুটি কলা খেতে দিলেন। তারপর বিশ টাকা আমাকে দিলেন। আমি টাকা উঠালাম। দোকানদার ভাইয়ের ঋণ পরিশোধ করলাম। আসলে উনার ঋণ পরিশোধ করতে পারি নাই, শুধু অর্থটাই ফেরত দিতে পেরেছিলাম। ঐ ঋণ পরিশোধ হবার নয়।
প্রথম কয়েক সেমিস্টার মন দিয়া ক্লাস করলাম। বাবার টাকার উপর ভর দিয়েই। খুব মজা। মাস্তি মারছি। কিন্তু দিনে দিনে আব্বার ব্যবসার অবস্থা আরো নাজুক হলো। ঋণে জর্জরিত মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবার কষ্ট গুলো তেমন শেয়ার করতো না। ঢাকায় কাজে এসে ছেলেকে দেখতে আসতো। বাবার ভাব থাকতো- “এখন তোমার বাবা তোমার সাথে তোমাকে কষ্ট করে নীলক্ষেতের চিপায় গিয়া ১৩ টাকায় পেট পূর্তি করতে হবেনা। কিংবা রাস্তার ধারে ১৫ টাকায় খিচুড়িও খেতে হবেনা। আজকে পৃথিবীটাই তোমার।” আমার বাপের সাহস আছে বলতে হবে। লোকটা দিনের পর দিন পরিশ্রম করে গেছে। আশানুরূপ সাফল্য আসে নাই। কিন্তু এই ব্যবসায়িক ব্যার্থ লোকটাই পৃথিবীতে সব চাইতে সফল মানুষ। কারণ এই লোকটাই আমাকে ভালো মন্দের তফাৎ শিখিয়েছে, সমাজে উঁচু নিচু বলে কিছু নাই তা শিখিয়েছে, লোকের সাথে মার্জিতভাবে কথা বললে কি ধরণের সুবিধা পাওয়া যায় তাও শিখিয়েছে। লোকটার কান্দে হাত দিয়া না হাটলে, ভালো লাগতো না। পাজামা পাঞ্জাবী তার সব সময়ের পোশাক। আমি জিন্স আর টিশার্ট ওয়ালা পাংকু খান। কিন্তু দোস্তি, সেটা মাকখন।
ঢাকায় আসার পর রিক্সাওয়ালাদের তুমি বলা শুরু করেছিলাম। বাবা একদিন মানা করলেন। না এটা ঠিক না বাবা। শুধরে নিলাম। এখন মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ থাকলে বলি, এই যাবা? কিন্তু, যাবি, আমার ভিতর থেকেই আসে না।
এই গুণের মত কয়েকটা ব্যবসায়িক গুণ বাবার থেকেই রপ্ত করেছি। ব্যার্থ ব্যবসায়িক গুণ গুলাও আজকাল কাজে দেয়।
বাবার কাছ থেকে শেখা ছোট ছোট শিক্ষা গুলা কাজে লাগানোর জন্য ব্যবসায়ী হওয়া জরুরি। কিছু করে দেখানোর ইচ্ছা। সেই পথেই হাটার একটা পাশাপাশি স্বপ্ন মনে লালন করতে থাকি কম্পিউটার সায়েন্স পড়ার পাশাপাশি। কিন্তু ঝুরিতে তেমন কোন আইডিয়া নাই। তাই যেখানে যা পাই সেই কাজই করি। কোন কাজে মানা নাই। আর কম্পিউটার সম্পর্কিত কোন কাজ হলেতো কথাই নাই। টাকা আমার যাই আসুক, কেয়ার করতাম না। কাজ করতাম। তখনকার সময় ডাটা এন্ট্রি করাই বেশি হতো। কিন্তু হঠাৎ একদিন একটা অফার পাইলাম একজনের কম্পিউটার সার্ভিসিং করতে গিয়া। ঐ আপা আমারে তাদের স্কুলের কম্পিউটার শিক্ষক হবার কথা বললেন। সুযোগটা পেতেই লুফে নিলাম। সিভি নিয়া গেলাম সিভি দেখে তারা আশ্চর্য হলো। ভিন্ন ধরনের সিভি ডিজাইন দেখে বললো সিভি এই রকম কেন? এইরকমও সিভি হয়? আমি ভাব নিলাম, বললাম সিভির মাধ্যমে তথ্য দেয়া হয়। আর এখানে আমার তথ্য নির্ভুল আছে, ডিজাইন যেমনই হোক।

স্কুলের মাস্টারি শুরু হলো। মেলা শর্ত। অফিসিয়াল চিঠিপত্র আমাকে লিখতে হবে। প্রশ্ন টাইপও আমার করতে হবে। আবার প্লে থেকে টেন অব্দি ক্লাস নিতে হবে। কম্পিউটার শিক্ষক বলে কথা :p। বেতন ৩৫০০ টাকা। ওসবতো করতামই মাঝে প্রক্সিও দিতাম। প্রক্সি দিতাম অন রিকুয়েস্ট। সেটার সংখ্যাও নেহায়েত কম ছিল না। মাসে ১০-২০ টা। রক্ত চোষা জোঁকের মত আমার তেল বের করলো ১১ টা মাস। হাল ছেড়ে দিলাম। আসলে ছাড়তে বাধ্য হলাম। ঐ স্কুলে থাকাকালীন সময় ছোট্ট একটা ঘটনা বলি। দু্ইটা প্যান্ট আর একটাই শার্ট প্রতিদিন পরতাম। আসলে টিশার্ট পরে স্কুলে যাওয়া মানা ছিল। আমাকে ঠিক শিক্ষক শিক্ষক লাগতো না। চেংড়া ছিলাম। তাই অগত্যা ঐ একটা শার্টই আমার সম্বল। আর একটা প্যান্টের পকেটের ঠিক নিচ অংশে অল্প একটু ছেড়া ছিল। প্রথম দিকে দেখাই যেত না। কিন্তু আমার তখনকার নিচু শ্রেণীর ভাগ্যের সাথে সাথে প্যান্টের ফুটোটাও বড় হতে থাকলো। একদিন ক্লাস ওয়ানের একটা বাচ্চা সেই ফুটোতে আঙ্গুল দিল। লজ্জা পাই নাই পোলাপান ছিল বলে। কিন্তু ভাগ্যের লজ্জা নিবারণ করার উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তবে চেষ্টায় ছিলাম।
আবার ডাটা এন্ট্রি জীবন। এইবার সহযোগী হিসেবে পেলাম আমার বন্ধু ও ফুফাতো ভাই, মহন (Aminul Islam)। চাকরিতে ঢুকায় দিলো। ওখানেই পরিচয় হলো কিছু উদার ও সৎ মানুষের সাথে। Mamun Wali, Atiqe Chowdhury তাদের মাঝে অন্যতম। আমি বয়সে ওনাদের ছোট ছিলাম বলেই আমাকে ভালোবাসতেন কিনা, জানিনা। তবে তাদের সাথে আমার জীবনের অনেক স্মৃতি জড়ানো। ওয়ালি ভাইয়ের সাথে আমার একটা স্মরণীয় ঘটনা আছে। অন্য একসময় বলবো। আপাতত আগাই।
আমার নিয়োগের কিছুদিন পরেই ডাটা এন্ট্রির কাজ বন্ধ হয়ে গেল। আমিও হতাশায় ডুবতে থাকলাম। তখন ইনকামের একমাত্র উপায় এন্থনিককে পড়ানো। ওখানে আমার একবেলা খাবার হয়। দুপুর বেলার। রাতের বেলার খাবার সুবির নন্দির গান আর বাসার ছাদ। শুক্রবারটা প্রায়ই না খেয়ে থেকেছি। কিছুটা নিজের বোকামি আর বাকিটা অর্থ কষ্ট। চললো মাস দুই বা তিন। এইবার আতিক ভাই হাজির রাতের বেলার একটা ডাটা এন্ট্রির কাজ নিয়ে। প্রথম কদিন আতিক ভাই থেকে কাজটা বুজে নিলাম মতিঝিল ২৪ তলা ভবনের পিছনে একটা অফিসে। আর সুযোগ এলো ইত্তেফাকে ফিচার লেখার। মিঠু চাচা পরিচয় করায় দিলেন সাজ্জাদ ভাইয়ের সাথে। আমিও সুযোগটা পকেটে পুরে নিলাম নগদ হাতে। অনুবাদ করা লেখার হাত ধীরে ধীরে পাকলো। ফিচার লিখতে লিখতে চান্স এলো স্টাফ হবার। হয়ে গেলাম। বাবার ব্যবসায় নিয়মিত ব্যার্থতায় বাবা-মা দুজনেই ভেঙে পড়ছিল দিন দিন। ছোট ভাইটাও তেলে জলে সব গুলায় ফেলতে শুরু করলো চট্টগ্রামে। অগত্যা বাবাকে পরামর্শ দিলাম ঢাকায় আমার কাছে চলে আসতে। সব পরিকল্পনা মাফিক হলো। বাবা, মা, ভাই ঢাকায় আসলো। ব্যবসা অফ করে দিল বাবা। ছোট একটা চাকরি নিল, মিরপুর। একটা ছোট রুমে ৫ জন থাকি। মা, বাবা, সিফাত, আমি আর মহন ভাইয়া। তিন ভাই রাতে কিবোর্ড পিটাই আর মা-বাবা ঘুমায়। দিনে আমরা ঘুমাই। মানে সিফাত আর ভাইয়া ঘুমায়। আমি দুই তিন ঘন্টা ঘুমিয়ে অনুবাদ করি। দৌড়াই ইত্তেফাক। টাকা বাচাতে শেখ সাহেব বাজার থেকে ৩০-৩৫ মিনিটে হেটে গুলিস্তান চলে যেতাম। দুপুরে খেয়েছি কিনা মা জানতে চাইলে বলতাম, হ্যাঁ খেয়েছি। ক্ষুধার্ত থাকতাম। অনেক ক্ষুধার্ত। পেট পিট লেগে থাকতো। আর আমার ইত্তেফাকের ভাই, আপুরা সিংগারা অফার দিলে মানা করতাম না। টপাটপ গিলতাম। ক্লাস মিস দেয়া শুরু হলো। ঘরে টাকা আসতেই হবে। যেভাবে হোক। ডাটা এন্ট্রিতে যে টাকা আসে তাতে চলা মুশকিল। মহন ভাইয়া আমাদের কষ্ট বুঝতে পেরে খুব দ্রুত অন্য একটা জায়গা ব্যবস্থা করে ফেললো।
আমি, বাবা, সিফাত তিনজনে ইনকাম করি। আবার মহন ভাইয়ার সাথে নাখালপাড়ায় বাসা নিলাম। ভাইয়া ভাবী থাকেন একরুমে। আমরা আরেক রুমে।
কোন মন্তব্য নেই